১৯৬১ সালের ২৪ নভেম্বর জহির রায়হানের ‘কখনো আসেনি’ মুক্তি পায়। এটি তার প্রথম চলচ্চিত্র। এর আগে তিনি এ জে কারদারের বিখ্যাত ‘জাগো হুয়া সাভেরা’সহ এহতেশাম, সালাউদ্দীনের মতো নামী পরিচালকের কয়েকটি চলচ্চিত্রে সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এই চলচ্চিত্র সাফল্য নিয়ে তার অনেক আশা ছিল। চলচ্চিত্রের কাহিনী,ভাষা নির্মাণও তাই বলে। এই চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘দেশের জনগণ বিশ বছর পরে যে ছবি দেখবে বলে আশা করেছিল বিশ বছর আগেই দেশের তরুণরা সে ছবি তাদের উপহার দিল’।
তরুণদের সেই প্রয়াস বাণিজ্যিকভাবে সফল হয় নাই, কিন্তু কাহিনী ও শিল্প মানে আজো স্মরণযোগ্য। জহির রায়হানের পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলো সফল হয়েছিল। কিন্তু এই প্রথমটি হয় নাই। বাহ্যিকভাবে এই চলচ্চিত্রের সাথে পরেরগুলোর অনেক তফাত রয়েছে। প্রশ্ন আসে, এই চলচ্চিত্রকে দর্শক কেন গ্রহন করে নাই। দর্শকদের চোখ ফুটে নাই নাকি তাদের কাছে এটাকে অনাত্মীয় মনে হয়েছিল। প্রশ্নটা ফেলে দেবার মতো না। সে প্রশ্ন এখনো অপ্রাসঙ্গিক নয়। আশা করি সেই প্রশ্নটা আপনাদেরও আলোড়িত করবে। আসুন আমরা আবার কাহিনীতে ফিরে যাই-

 Download Link

খান আতাউর রহমান ও সুমিতা দেবী
খান আতাউর রহমান ও সুমিতা দেবী
একজন চিত্রশিল্পী আর তার দু’বোন একসঙ্গে রহস্যজনকভাবে মারা যায়।পুলিশ আবিষ্কার করে দু’বোন পাশাপাশি শুয়ে আছে এমন ছবি। একই বাড়িতে কিছুদিন পর বসবাস করতে আসে আরেকজন চিত্রশিল্পী, নাম শওকত আর তার দু’বোন। তাদের সামনের বাড়িতে  থাকেন অদ্ভুত আত্মভোলা সেই সৌখিন শিল্প সংগ্রাহক সুলতান। তার মতে, ‘সৌন্দর্যকে কাছে পাওয়া যায় না, অনুভব করা যায় মাত্র’। তার সংগ্রহের তালিকায় আছে সৌন্দর্যের প্রতীক অমর মানবী মরিয়ম। শওকতের  সাথে মরিয়মের পরিচয় হয়। শওকত তার ছবি আকতে চায়। একসময় তারা দুজন দুজনের প্রেমে পড়ে। কিন্তু সুলতান বলে, ‘কোটি কোটি মানুষ ঘাসের মতো গজায়, সাধারণ মানুষের মতো বিয়ে করে একগাদা বাচ্চা পয়দা করার মধ্যে কি আছে? মাতৃত্ব? মাতৃত্ব তো গরুর দুধের মতো কোলে কোলে হয়’।  মরিয়ম ও শওকত ঠিক করে একটা নির্দিষ্ট দিনে তারা দূরে কোথাও পালিয়ে যাবে।
সেই দিনেই শওকত ও তার দু’বোন রহস্যজনকভাবে মারা যায়। মৃত্যুর আগে সে এঁকে যায় পাশাপাশি শুয়ে থাকা দু’বোনের ছবি। মৃত দু’বোন অবিকল সেভাবে শুয়ে থাকে। সময় প্রবাহে সে বাড়িতে নতুন লোক উঠে। চিত্রশিল্পী আর দু’বোন। ব্যালকনিতে মূর্তির মতো দাড়িয়ে সে দৃশ্য দেখে মরিয়ম। আবার কি নিয়তির পুনরাবৃত্তি! আবিষ্ট দর্শকের মনে এমন প্রশ্ন জাগিয়ে শেষ হয় ‘কখনো আসেনি’। চলচ্চিত্রের নাম যদিও কখনো আসেনি তারপরও দর্শক ভাবে মুক্তি আসবে।এটা শুধু মরিয়মের মুক্তি নয়। পঞ্চাশ বছর পর যখন বাংলা চলচ্চিত্রকে বাচানোর লড়াই সংগ্রাম হচ্ছে, সে দিকে তাকালে দেখি এই মুক্তি আমাদের চলচ্চিত্রের, শিল্পের, জীবনবোধের। সেটাও কখনো আসেনি। গুটি কয়েক নির্মাতা আমাদের যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তা বাস্তবতার জমিনে পয়দা হয় নাই।
এই চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলে সৌন্দর্য, শিল্প – এই নিয়ে। এগুলোর সাথে জীবনের কি সম্পর্ক। আমাদের প্রতিদিনকার যাপন, প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ, হাসি-কান্নার ভেতর সেই শিল্পের বসবাস। জীবন্ত শিল্প মরিয়ম জীবনে প্রেম আসে,আসে বিরহ। এই কামনা বাসনাময় জীবনের নিজস্ব শিল্পিত রূপ আছে। যা সুলতান বুঝে না। শওকত যখন শুনে একলোক ভ্যানগগের দোহাই দিয়ে বলছে, ‘শিল্প করলে তার মতো পেটে পাথর বেঁধে করতে হবে’। বাস্তব জীবনের সাথে শিল্পী জীবনের ফারাক থাকতে হয়। তখন সেই লোকের সানগ্লাস নিজ হাতে খুলে নিয়ে শওকত বলে, ‘জীবনটাকে চশমা খুলে দেখুন’। রঙিন চশমা খুলে দুনিয়াকে দেখার এই জনপ্রিয় সংলাপের উৎস কি এই চলচ্চিত্র? এই আবিষ্কারে এইকালের দর্শক মুগ্ধ!
কখনো আসেনি মুক্তি পেয়েছিলো পঞ্চাশ বছর আগে। এই পঞ্চাশ বছরেও বিভেদহীন চলচ্চিত্র নির্মাণের চিন্তায় সুস্থির হতে পারি নাই। জহির রায়হান, খান আতাউর রহমান, সালাউদ্দিনের পর এই ধারা ক্ষীণ থেকে ক্ষীনতর হয়েছে। আলমগীর কবিরে সেই চেষ্টা ছিলো। এরপর থেকে সকলি বিকল্প হবার উচ্চবর্গীয় বাসনা।  তারেক মাসুদ বিকল্প কোন কিছুর স্বীকার না করে ভালো চলচ্চিত্র আর মন্দ চলচ্চিত্রের ভাগ করেন।সেই লক্ষ্যে তিনি জেলা শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে দর্শকের চোখ তৈরি করতে তার নির্মিত চলচ্চিত্র নিয়ে ঘুরেছেন।তিনি সিনেমা হল রক্ষার বিষয়েও জনমত তৈরির চেষ্টা করছিলেন।  সে প্রয়াস তার প্রয়াণে অসমাপ্তই থেকে গেল। ইতিমধ্যে ইন্ডিয়ান বাংলা চলচ্চিত্র প্রদর্শন নিয়ে তোলপাড় আমরা দেখছি।
পাকিস্তানী আমলের কঠিন পরিবেশে ‘কখনো আসেনি’ দিয়ে জহির রায়হান শুরু করেছিলেন,যার শেষ ‘জীবন থেকে নেয়া’ দিয়ে।তারা উর্দু চলচ্চিত্রের আগ্রাসন ঠেকিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের একটা ধারা তৈরি করেছিলেন। এটা রাজনৈতিক প্রশ্নও বটে। আজো সেটা রাজনৈতিক। আজ নানা প্রশ্নে সমস্যা আরো বেড়েছে। কিন্তু এই কলিকালে আমাদের সামনে কে বা কি আছে? ঘুরে ঘুরে একই ইতিহাসে ফিরে আসাই কি নিয়তি।

Download Link


0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

 
Top